আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ও খ্যাত। এমন পরিচয় অনেকেরই আছে- আগামীদিনেও অনেকে আবির্ভূত হবেন, তা সন্দেহাতীত ও বলাবাহুল্য। কিন্তু তার মতো বিচক্ষণ সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ ক’জন জন্ম নেবেন সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ ও নিবিড় গবেষণার বিষয়। আবুল মনসুর আহমদের বিশিষ্টতা ও ব্যতিক্রমিতা হলো- তিনি সাহিত্যিক সত্তার জন্য শুধু সৃজনশীল ও মননশীল লেখালেখি, সাংবাদিক হিসেবে সংবাদপত্রের জন্য শুধু লেখালেখি ও সম্পাদকীয়তা পরিচালনা করেননি। আবার রাজনীতিবিদ হিসেবে শুধু মিটিং-মিছিল-বক্তৃতা-জনবান্ধব ভূমিকা পালন-নির্বাচনে দাঁড়ানো-জয়ী হওয়া এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা কাঠামোয় অধিষ্ঠিত হয়ে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেননি। তিনি এসবের ভেতরেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। এই ‘বিচক্ষণতা’ বোধ তাকে আজও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন, আগামীতেও করবেন যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই অগ্রসব সমাজ-রাষ্ট্র-দেশ বিনির্মাণের লড়াই জারি রাখি। সংক্ষিপ্ত পরিসরের এই লেখায় রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের বিচক্ষণতার পরিচয় অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হবে। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তার প্রাসঙ্গিকতা আজও কেন অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয় এবং কেনই বা তিনি মৃত্যুর ৪২ বছর পরও নিবিড় অধ্যয়ন ও গবেষণার দাবি রাখে- তা খুঁজতেই এই লেখা। আবুল মনসুর আহমদের রাজনীতিতে বিচক্ষণতার দিকটি অবলোকন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার স্বীকৃতি মেলে শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। তিনি লিখেছেন, ‘মওলানা সাহেব ঢাকায় রওয়ানা করে গেলেন। আমি মিটিংগুলি শেষ করে রওয়ানা হব। এমন সময় খবর পেলাম, হক সাহেব ও মওলানা ভাসানী দস্তখত করে যুক্তফ্রন্ট করে ফেলেছেন। আমি বুঝতে পারলাম না, ভাসানী সাহেব কি করে দস্তখত করলেন! শহীদ সাহেবের অনুপস্থিতিতে কি প্রোগ্রাম হবে? সংগঠনের কি হবে? নমিনেশন কোন পদ্ধতিতে দেওয়া হবে? কেনই বা মওলানা সাহেব এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন? কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঢাকায় ফিরে এসে ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে মওলানা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। নিচের কামরায় আওয়ামী লীগের অফিস। অফিসে যেয়ে যখন বসেছি, তখন কর্মীরা আমায় খবর দিল, কীভাবে কি হয়েছে। আবুল মনসুর আহমদ সাহেব বিচক্ষণ লোক সন্দেহ নাই। তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন এবং তাড়াতাড়ি কফিলুদ্দিন চৌধুরীর সাহায্যে একুশ দফা প্রোগ্রামে দস্তখত করিয়ে নিলেন হক সাহেবকে দিয়ে। তাতে আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং আরও কতকগুলি মূল দাবি মেনে নেওয়া হল।’ লক্ষণীয়, ‘বিচক্ষণ’ শব্দটির প্রয়োগ এবং এর পরের বাক্যবন্ধ। বঙ্গবন্ধু যে আবুল মনসুর আহমদের বিচক্ষণতার ওপর ভরসা করতেন এবং আস্থা রাখতেন উদ্ধৃতাংশে তা স্পষ্ট। তরুণ নেতা শেখ মুজিব তখন রাজনীতির ভেতর-বাইরের জটিল ও কুটিল পথ সামলাচ্ছেন। দলের অভ্যন্তরের হিসেবে-নিকেশ মিলিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। আবার কেন্দ্রের দল-উপদলের কোন্দল ও মেরুকরণকেও মোকাবিলা করছেন। এই ভূ-খণ্ডের রাজনীতির বিকাশ ও চর্চা শুরুর প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু যখন নানাভাবে লড়ে যাচ্ছেন, তখন রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় আবুল মনসুর আহমদকেই শ্রেষ্ঠ ও শ্রেয় জ্ঞান করছেন। ফলে, আমরা দেখি যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রক্রিয়া এবং পথচলার ধরণ ও পদ্ধতি নিয়ে সন্দেহ, প্রশ্ন ও অমীমাংসিত বিষয়-আশয় নিয়ে দলের সেক্রেটারির প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি দলীয় সভাপতির ভূমিকা ও কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়েও দলের সেক্রেটারি শেখ মুজিবের সংশয় ও ধোঁয়াশা রয়েছে। কিন্তু, যুক্ত ফ্রন্টের ২১ দফা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ও দোলাচল নেই। যদি থাকত তাহলে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তার সাক্ষ্য নিশ্চয় মিলত। ১৯৫৪ সালের একুশ দফার ‘অন্যতম প্রণেতা’ ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। এই সত্যতা ও স্বীকৃতিও মিলেছে শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ের জীবনবৃত্তান্তমূলক টীকায় আবুল মনসুর আহমদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে ‘আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮- ১৯৭৯): সাহিত্যিক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতা, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচি ২১ দফার অন্যতম প্রণেতা। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।’ ১৯৫৪ সালের ২১ দফা পাকিস্তানের রাজনীতি, ক্ষমতা কাঠামো ও ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেয়। মুসলিম লীগের মতো নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর ও দোর্দন্ডপ্রতাপশালী শাসকদলের ভূমিধ্বস পরাজয় ঘটে। শুধু তাই নয়, ২১ দফার প্রেক্ষিতে ও দাবি অনুযায়ী পরবর্তীতে ২১ শে ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলে, বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত করা হয় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংবিধান রচিত ও গৃহীত হয়। ২১ দফাকে ’২১ দফা হিসেবে চিহ্নিত ও সংজ্ঞায়িত করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ’৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি চেতনা বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বাংলা ভাষার মর্যাদা ও ন্যায় সংগত দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষে ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে আত্মত্যাগের ঘটনা ছিল মূলত ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বীজমন্ত্রস্বরূপ। যা পরবর্তীতে স্পষ্ট ও অনিবার্য এক সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে এভাবে প্রতিকায়িত করার ক্ষেত্রে ২১ দফার প্রণেতা হিসেবে আবুল মনসুর আহমদ যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন, তা রাজনীতিবিদ হিসেবে তাকে কালোত্তীর্ণ এবং বাংলাদেশ ও বাঙালির রাজনীতিবিদ হিসেবে চিরায়ত প্রাসঙ্গিকতার বিরল মর্যাদা দিয়েছে। উল্লেখ্য, ২১ দফার নীতি ছিল, ‘কোরান ও সুন্নাহর আলোকে নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।’ সেই সময়ের বাস্তবতায় এই নীতি যে অপরিহার্য ছিল তা যথার্থ ও যুক্তিসংগতভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। এখন আমরা ২১ দফার ১৯ নাম্বার দফাটা একটু স্মরণ করতে চাই। উল্লিখিত হয়েছে, ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও সার্বভৈৗমিক করা হইবে ও দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় (অবশিষ্টাত্মক ক্ষমতাসমূহ) পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান ও নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণ করত: আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্রবাহিনীতে পরিণত করা হইবে।’ ’৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ছয় দফাকে বলা হয় বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ছয় দফার দিকে আমরা যদি একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিই তাহলে দেখব- এতে সময়ের প্রয়োজনে কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। ২১ দফার ১৯ নাম্বার দফাকে বিস্তৃত পরিসরে ও সুনির্দিষ্টরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় দফাটা একটু দেখে নিই। প্রথম দফা- লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৈৗম হবে। দ্বিতীয় দফা- ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত ও রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে। ছয় দফা যখন প্রণীত হচ্ছে তখন রাজনীতিতে সক্রিয় নেই আবুল মনসুর আহমদ। রাজনীতিতে শেখ মুজিব তখন আর তরুণ নন, ইংরেজিতে যাকে বলে ম্যাচিউরড-বাংলায় পরিণত। দলের সভাপতি। ছয়দফার মধ্য দিয়ে তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নতুন এক বার্তা হাজির করলেন। যা শাসকদলের কাছে দফা নয় মিসাইল হিসেব দেখা দিল। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা যখন স্বৈর সামরিক শাহী আইয়ুবের কাছে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে বিড়ালের মতো মিউমিউ করছিল, তখন খোদ পশ্চিম পাকিস্তানেই ছয় দফা দিয়ে হুংকার দিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ২১ দফা ও ছয় দফার তুলনামূলক পাঠ ও পর্যালোচনায় পরিষ্কার দেখা যায় ছয় দফাতে নতুনত্ব যেমন আছে, তেমনি ২১ দফার উপস্থিতিও আছে বিশেষ করে ১৯ নাম্বার দফা। আবুল মনসুর আহমদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ছিল বলেই তিনি ২১ দফাকে এমনভাবে প্রণয়ন করেছিলেন যা শুধু সেই সময়ে বা নির্দিষ্ট সালের মধ্যে তার প্রয়োজনীয়তা সীমাবদ্ধ ছিল না, পরবর্তীতেও তার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ছিল। একারণে এক যুগ পেরিয়ে কিংবা কাছাকাছি সময় অতিক্রম করে যখন ছয় দফা প্রণীত হয়েছে তখনো তার চিন্তা- চেতনা- কার্যাবলীর ছাপ থেকে যাচ্ছে। তা সচেতন-অবচেতন-অচেতন যে অবস্থাতেই হোক না কেন। আবুল মনসুর আহমদের বিচক্ষণতার আলোচনায় এবার আমরা দুই অর্থনীতির প্রসঙ্গে একটু মনোযোগী হতে চাই। একথা সর্বদা সত্যি ও সর্বজনস্বীকৃত যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিনির্মাণে ‘দুই অর্থনীতি’ পালন করেছে চাবিকাঠির ভূমিকা। পাকিস্তানের শাসকেরা দুই অর্থনীতির মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চরম বৈষম্যের সৃষ্টি করে। যা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে ত্বরান্বিত ও সুগম করে এবং এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এই বৈষম্য আবির্ভূত হয় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চাবিকাঠিরূপে। কিন্তু, কীভাবে-কীরূপে-কোন প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতার মধ্য দিয়ে চিহ্নিত হলো দুই অর্থনীতি, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসেও তা সুস্পষ্ট যেমন নয় তেমনি অনালোকিত-অনালোচিতও বটে। দুই অর্থনীতি কি অর্থনীতিবিদদের চিন্তাপ্রসূত, নাকি রাজনীতিবিদরাই প্রথম এটিকে শনাক্ত ও চিহ্নিত করার পরই অর্থনীতিবিদরা সবিস্তারে- গবেষণার মাধ্যমে সকলের মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন? এই প্রশ্নের তথ্য-উপাত্তের আলোকে গবেষণালব্ধ সুরাহা ও ইতিহাসের দায় মেটানো হয়নি আজও। ঐতিহাসিক সত্য হলো, রাজনীতিবিদরাই প্রথম বিষয়টিকে বিবেচনায় আনেন এবং পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে তথ্য-উপাত্ত হাজির করে দুই অর্থনীতির সর্বনাশা ও ভয়ঙ্কর ক্ষতির দিকটি সর্বপ্রথম তুলে ধরেন আবুল মনসুর আহমদ। সময় পরিক্রমায় দুই অর্থনীতির বিষয়টি হয়ে ওঠে ক্রমশ স্পষ্ট ও প্রকট। এবং অর্থনীতিবিদরা তাদের গবেষণার মধ্য দিয়ে এর গভীরে যেমন প্রবেশ করেছেন, তেমনি এর প্রতি তুলনার পাশাপাশি পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব-নিকাশ দিয়ে শোষণ-বঞ্চনার প্রকৃত চিত্র জনসমক্ষে-রাজনীতিবিদদের কাছে এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও ফোরামসমূহে হাজির করেছেন। এক্ষেত্রে নূরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, ওয়াহিদ উদ্দীন প্রমুখের সম্পৃক্ততা থাকলেও রেহমান সোবহান কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষিত ও পরম্পরায় বিশেষভাবে আলোচিত হন। সেদিন গণপরিষদের বক্তৃতায় আবুল মনসুর আহমদ সুনির্দিষ্ট করে বলেছিলেন, ‘লাহোর প্রস্তাব ব্যতীত অন্য কোনো বুনিয়াদে যে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হইতে পারে না, তা দেখাইতে গিয়া আমি বলিয়াছিলাম: ২. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আসলে দুইটি দেশ; ৩. উহাদের বাসিন্দারা আসলে দুইটি জাতি; ৪. দুই পাকিস্তানের আসল সমস্যা রাজনৈতিকের চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক; কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ দুইয়ের এক ও অভিন্ন নয়; ৫. সরকারি আয় জনগণের ব্যয়, সরকারি ব্যয় জনগণের আয়, এই নীতিতে সরকারি ব্যয় হইতে পূর্ব বাংলার কোনো লাভ হয় নাই; ৬. পূর্ব বাংলা হইতে যে টাকা পশ্চিমে আসে, তা আর ফিরিয়া যায় না। এটা কার্যত একরোখা অর্থনীতি; ৭. এই একরোখা অর্থনীতির বিষময় পরিণাম কীভাবে দেশের অনিষ্ট সাধন করিতেছে তা দেখাইতে গিয়া আমি সরকারি স্ট্যাটিসটিকস হইতে বিস্তারিতভাবে ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগার্স’ কোট করিয়া দেখাইয়াছিলাম: ক. দেশের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় এবং দুই অঞ্চলের মধ্যে মবিলিটি অব লেবার ও ক্যাপিটাল না থাকায় সরকারি সমস্ত ব্যয়ের, সরকারি গৃহনির্মাণাদি সাকল্য খরচের, সবটুকু সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তান পাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তান এর একবিন্দু সুবিধা পাইতেছে না। খ. শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্যের সব প্রতিষ্ঠান পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত ও এখান হইতে পরিচালিত হওয়ায় এই সবের সকল সুবিধাই আঞ্চলিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতি সাধন করিতেছে। গ. দেশের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে হওয়ায় ব্যাংকিং, ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস এবং বিদেশি মিশনসমূহের অফিস ও ক্রিয়াকলাপ পশ্চিম পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ থাকিতেছে। এসবের আর্থিক সুবিধা শুধু পশ্চিম পাকিস্তান পাইতেছে। ঘ. সরকারি চাকরিতে দেশের মোট রাজস্বের শতকরা পঁচিশ টাকার বেশি (তৎকালে এক শ পঞ্চাশ কোটির মধ্যে সাড়ে বত্রিশ কোটি) ব্যয় হইতেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উপরের চাকরির শতকরা এক শটি এবং মধ্য ও নিম্ন-মধ্য চাকরির শতকরা আশি-নব্বইটি পশ্চিম পাকিস্তানিরা অধিকার করিয়া থাকায় এই হইতে যে বিপুল আয় হয় তার সবটুকু পশ্চিম পাকিস্তানিরাই পায়। ব্যয়ও হয় পশ্চিম পাকিস্তানেই। প্রতিবছর পশ্চিম পাকিস্তান এই হারে ধনী ও পূর্ব পাকিস্তান এই হারে গরিব হইতেছে। ঙ. দেশরক্ষা বাহিনীর পিছনে দেশের মোট রাজস্বের শতকরা ৬২ ভাগ (তৎকালে এক শ পঞ্চাশ কোটির মধ্যে এক শ দশ কোটি) ব্যয় হয়। দেশরক্ষা বাহিনীর কোনো বিভাগে পূর্ব পাকিস্তানি অফিসার একরূপ না থাকায় এই বিপুল আয় হইতে তারা সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। চাকরি-বাকরি ছাড়াও সরবরাহ বা নির্মাণকার্যের কন্ট্রাক্টরি হইতে তারা বঞ্চিত। ইহার ফলস্বরূপ প্রতিবছর এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানকে ধনী ও তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানকে গরিব করিতেছে।’ বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে স্বীকৃত ‘ছয় দফা’ প্রণয়নের ক্ষেত্রে দুই অর্থনীতির তত্ত্ব বীজমন্ত্রের ভূমিকা পালন করেছে। পাঁচের দশকের শেষ দিকে থেকে দুই অর্থনীতির ফারাক যেমন ক্রমশ বেড়েছে, তেমনি সেই ফারাক থেকে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলনের-সংগ্রামের জন্য তৈরি হয়েছে। দুই অর্থনীতি থেকে উত্থিত ক্ষোভ-দুঃখ-বেদনা-হতাশা-নিগ্রহ-শোষণ-বঞ্চনা বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য করেছে ইস্পাত কঠিন শপথে দীক্ষিত ও উৎসর্গীকৃত। নয় মাসের লড়াই শেষে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষায় স্বাধীনতা এসেছে, কাল পরিক্রমায় সময় গড়িয়েছে পঞ্চাশ বছর। কিন্তু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার চাবিকাঠি ‘দুই অর্থনীতি’র সুলুকসন্ধান এবং ইতিহাসের দায় মেটানো হয়নি আজও। সেই দায় মেটানো হলে আবুল মনসুর আহমদের বিচক্ষণতার দিকটাও যেমন উন্মোচিত হতো তেমনি আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোর মৌল নীতিসমূহ বাস্তবায়নে গরিষ্ঠ ভূমিকা পালনের সুযোগ সৃষ্টি হতো। কেননা, ১৯৫৬ সালেই তিনি পরিসংখ্যান টেনে বলেছিলেন, ‘আমি তাঁদের আরও বিস্মিত করিয়া বলিয়াছিলাম: ‘বর্তমান পূর্ব পাকিস্তান দেয় শতকরা চৌদ্দ। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার বছর দিয়াছিল শতকরা ত্রিশ। আট বছরে শতকরা ষোলো কমিয়া হইয়াছে চৌদ্দ। বছরে দুই কমিয়াছে। বাকি চৌদ্দ কমিয়া শূন্যে আসিতে লাগিবে আর মাত্র সাত বছর। ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জমার খাতায় যখন শূন্য হইবে, তখন আপনারা ন্যায়তই বলিতে পারিবেন: পূর্ব পাকিস্তান লোকসানের কারবার। ওটা লিকুইডেট করা যাইতে পারে।’ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ব্যাংকিং, ইনস্যুরেন্সসহ সমস্ত শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস করাচীতে হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে অর্জিত সকল আয় পশ্চিম পাকিস্তানের হিসাবে জমা করার সুবিধা ছিল।’ ইতিহাসের সত্য হলো বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে দুই অর্থনীতি পালন করেছিল চাবিকাঠির ভূমিকা। কিন্তু, আমাদের পঠন-পাঠনে, রাজনীতি-অর্থনীতিতে, ইতিহাস চর্চায় দুই অর্থনীতির উপস্থিতি প্রবল তো নয়ই, অপ্রতুল ও প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন। সংসদীয় গণতন্ত্র, শাসক ভোটার সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ তারও বিচক্ষণ উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় আবুল মনসুর আহমদের লেখালেখিতে। রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইয়ে তিনি বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধু আসন্ন নির্বাচনেই নয় আগামী পঁচিশ বছরের নির্বাচনে জিতিবে এবং দেশ শাসন করিবে। আমি এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ শাসনকে ভারতের কংগ্রেসের পঁচিশ বছরের আমলের সাথে তুলনা করিয়াছিলাম।… তিনশ পনর সদস্যের পার্লামেন্টে জনা-পঁচিশেক অপজিশন মেম্বর থাকিলে সরকারী দলের কোনই অসুবিধা হইত না। বরঞ্চ ঐ সব অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান অপজিশনে থাকিলে পার্লামেন্টের সৌষ্ঠব ও সজীবতা বৃদ্ধি পাইত। তাঁদের বক্তৃতা বাগ্মিতায় পার্লামেন্ট প্রাণবন্ত দর্শনীয় ও উপভোগ্য হইত। সরকারী দলও তাতে উপকৃত হইতেন। তাঁদের গঠনমূলক সমালোচনার জবাবে বক্তৃতা দিতে গিয়া সরকারী দলের মেম্বররা নিজেরা ভাল-ভাল দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হইয়া উঠিতেন। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের একটা ট্রেনিং কলেজ হইয়া উঠিত। আর এ সব শুভ পরিণামের সমস্ত প্রশংসা পাইতেন শেখ মুজিব।’ এখানে আবুল মনসুর আহমদ কতোটা বিচক্ষণতা বোধের পরিচয় দিয়েছেন তা বুঝতে আমাদেরকে একটু জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। যদ্যপি আমার গুরু বইয়ে সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক আহমদ ছফা উল্লেখ করেছেন, ‘আহমদ ছফা আরেকবার শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাককে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে উনার মতামত জানতে চাইলেন। তখনও শেখ সাহেব বেঁচে আছেন। রাজ্জাক স্যার একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বললেন, ‘নাইনটিন সিক্সটি থেকে নাইন্টিন সেভেনটি ওয়ান পর্যন্ত শেখ সাহেব যারেই স্পর্শ করছেন, তার মধ্যে আগুন জ্বালাইয়া দিসেন। হের পরের কথা আমি বলবার পারুম না। আমি গর্ভমেন্টের কারো লগে দেখাসাক্ষাৎ করি না। সেভেন্টি টুতে একবার ইউনিভার্সিটির কাজে শেখ সাহেবের লগে দেখা করতে গেসিলাম। শেখ সাহেব জীবনে অনেক মাইনসের লগে মিশছেন তো আদাব লেহাজ আছিল খুব ভালা। অনেক খাতির করলেন। কথায় কথায় আমি জিগাইলাম, আপনার হাতে তো অখন দেশ চালাইবার ভার। আপনি অপজিশনের কী করবেন। অপজিশন ছাড়া দেশ চালাইবেন ক্যামনে। জওহরলাল নেহরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয়প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, তোমরা অপজিশন পার্টি গইড়্যা তুলো। শেখ সাহেব বললেন আগামী নির্বাচনে অপজিশন পার্টিগুলো ম্যাক্সিমাম পাঁচটার বেশি আসন পাবে না। আমি একটু আহত অইলাম, কইলাম আপনে অপজিশনরে একশো সিট ছাইড়া দেবেন না? শেখ সাহেব হাসলেন, আমি চইলা আসলাম। ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার একটা সুযোগ দিসিলো। তিনি এইডা কাজে লাগাইবার পারলেন না।’ আবুল মনসুর আহমদ ও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ভাবনা কতোটা সমান্তরাল ও যুক্তিসংগত তা উপলব্ধি করতে আমাদের আর বেগ পাওয়ার কথা নয়। তবুও আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইয়ে উল্লিখিত একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করে শেষ করব এই লেখা। তিনি লিখেছেন, ‘…৭০ সালের নৌকা ও এবারকার নৌকার মৌলিক পার্থক্য আছে। ৭০ সালেরটা ছিল চড়িবার নৌকা। এবারকারটা চালাইবার নৌকা। নৌকা চালাইতে ডাইনে-বাঁয়ে দুই সারি দাঁড়ি লাগে। নৌকার হাল ধরিবেন শেখ মুজিব নিজে ঠিকই, কিন্তু দাঁড়ি হইবেন দুই কাতারের। সব দাঁড়ি একদিক হইতে দাঁড় টানিলে নৌকা সামনে চলিবার বললে ঘুরপাক খাইয়া ডুবিতে পারে। …এবারকার (১৯৭৩ সালের) নির্বাচনের প্রাক্কালে অনেক রাষ্ট্র-দার্শনিক ভবিষ্যৎবাণী করিয়াছিলেন: ‘বাংলাদেশের ভোটাররা বরাবর এক বাক্সে ভোট দেন,’ আর ‘তাঁরা বরাবর সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেন।’ আমি ঐ সব রাজনৈতিক গণকদের কথার প্রতিবাদ করিয়াছিলাম। তাঁরা ’৪৬ সাল, ’৫৪ সাল ও ’৭০ সালের নির্বাচনের নজির দিয়া তাঁদের কথার সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমি তাঁদের কথার প্রতিবাদে বলিয়াছিলাম, ঐ তিন সালের কোনওটাই সরকার গঠনের মামুলি নির্বাচন ছিল না। সেগুলি ছিল মূলনীতি নির্ধারণের ভোট। ’৪৬ সালেরটা পাকিস্তান বনাম অখণ্ড ভারতের ভোট, ৫৪ সালের একুশ দফা ও ৭০ সালের ছয় দফা উভয়টাই ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বনাম স্ট্রংসেন্টারের ভোট। ঐ সব নির্বাচনে এক বাক্সে ভোট না দিয়া উপায় ছিল না। কারণ উভয়টাই ছিল জনগণের দাবি। কিন্তু ’৭৩ সালের নির্বাচনে ঐ ধরণের কোন মূলনীতি নির্ধারণের প্রশ্ন ছিল না। ওটা ছিল নিতান্তই সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্ন। …বাংলাদেশের ভোটাররা এবার তাই করিয়াছেন। নির্বাচিত সরকাররা যে সব ভুল করেন, গণতন্ত্রের বিচারে সেসব ভুলের জন্য ভোটাররাও দায়ী। আর ভোটাররা নিজেরা যে ভুল করেন, তার জন্য দায়িত্ব বহন ও ফলভোগ তাঁদের করিতেই হইবে।’ শুধু সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ হলে হয় না, বিচক্ষণতা থাকাটা কতটা জরুরি ও অপরিহার্য তা আবুল মনসুর আহমদের জীবন ও কর্মের প্রতি দৃষ্টি ও নিবিড় মনোযোগ দিলে উপলব্ধ ও স্পষ্টত হয়। বাংলা অভিধান বলছে, বিচক্ষণ শব্দের অর্থ হলো, অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান, দূরদর্শী, কর্মকুশল। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, আবুল মনসুর আহমদের ভেতর চারটি শব্দেরই যথার্থ ও যুতসই প্রয়োগ ঘটেছে এবং তিনি জীবনভর বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। ড. কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক।