অর্থনীতি পুরোপুরি পুনরুদ্ধারের পথে, এ কথা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। নতুন বছরটি কেমন হবে, এ নিয়ে এখনো রয়েছে নানা অনিশ্চয়তা, শঙ্কা, দুশ্চিন্তা ও হুমকি। কিছু সমস্যা বৈশ্বিক, কিছু আছে একান্তই বাংলাদেশের। সুতরাং নতুন বছরের অর্থনীতি কেমন হবে, তা জানতে প্রয়োজন কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা। সাধারণ মানুষের পূর্বাভাস সদ্য বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে বিশ্বব্যাপী একটি জরিপ করেছিল প্যারিসভিত্তিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইপসস। বিশ্বের ৩৩টি দেশের ২২ হাজার মানুষকে তারা ২০২২ সালের পূর্বাভাস নিয়ে প্রশ্ন করেছিল। জরিপে দেখা গেছে, ৬১ শতাংশই মনে করেছে বিশ্ব অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো হবে। আর ৭৭ শতাংশের প্রত্যাশা হচ্ছে, আগের বছরের তুলনায় নতুন বছরে তিনি ভালো থাকবেন। কোভিড-১৯ নিয়ে আশঙ্কা থাকলেও ৫৬ শতাংশই মনে করে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ মানুষই কমপক্ষে এক ডোজ করে হলেও টিকা পাবেন। তবে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা কিছু শঙ্কার কথাও বলেছেন। যেমন ৭৫ শতাংশেরই ধারণা, ২০২২ সালে দ্রব্যমূল্য বাড়বে তাদের আয়ের চেয়েও বেশি। আর ৩৫ শতাংশই মনে করে, নতুন বছরে বিশ্বের প্রধান প্রধান শেয়ারবাজারে ধস নামবে। অর্থনীতির পাঁচ দুশ্চিন্তা মার্কিন বার্তা সংস্থা সিএনবিসি গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ওয়াল স্ট্রিটের ৪০০ প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা, সম্পদ বিশ্লেষক ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপকদের মধ্যে একটি জরিপ করে। জরিপে অংশ নিয়ে ৫৩ শতাংশই বলেছে, অর্থনীতিতে ২০২২ সালের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। আর ৩০ শতাংশ মনে করে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক যে সুদহার বাড়ানোর কথা বলছে, সেটাই আসলে বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। আর ১৭ শতাংশের ধারণা, কোভিড ও এর অর্থনৈতিক প্রভাবই আসলে এখনো বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান সংকট। সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী বড় বড় অর্থনীতিবিদ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ ব্যবস্থাপকেরা নতুন বছরের জন্য হুমকি হিসেবে পাঁচটি বিষয়কে চিহ্নিত করছে। ১. মূল্যস্ফীতি: সবার ক্ষেত্রেই অবশ্য প্রধান হুমকি বা দুশ্চিন্তার নাম মূল্যস্ফীতির চাপ। অমিক্রন আসার আগে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি যে শ্লথ হয়ে পড়েছিল, তার প্রধান কারণ ছিল এই মূল্যস্ফীতি। ২০২১ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্কলন ছিল তাদের মূল্যস্ফীতি হবে ২ শতাংশ। কিন্তু বছরটি শেষ হয়েছে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে। এমনিতেই বৃহৎ অর্থনীতিগুলোতে মজুরির হার বাড়ছে। আবার রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে উত্তেজনার কারণে জ্বালানি তেলের দাম আবারও বাড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। এতে খাদ্য মূল্য আরও বাড়বে। সুতরাং মূল্যস্ফীতি নিয়ে আছে বহুমুখী দুশ্চিন্তা। ২. অমিক্রন: বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে যে এখনো বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে, তার কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার থেকে আসা কোভিডের নতুন ধরন অমিক্রন। এটি কতটা প্রাণঘাতী তার ওপরেই নির্ভর করছে অনেক কিছু। ৩. সুদ হার: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বেড়ে গেল বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ডলারেরও দর বাড়বে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা কম নয়। সাধারণত, ফেড মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে মুদ্রা নীতি তৈরি করে।এ ক্ষেত্রে অস্ত্র হচ্ছে কাঠামোগত সুদ হার নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ, মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে সাধারণত সুদ হার কমিয়ে দেয়। কিন্তু নতুন বছরে উল্টো পথে যেতে পারে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর সঙ্গে কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতি সমন্বয় করে চলবে, এ নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা দুশ্চিন্তা। ৪. শেয়ারবাজার: এখন অনেকেরই আশঙ্কা, নতুন বছরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কম মুনাফা পাওয়া যাবে। ৫. বৈষম্য: আর সর্বশেষ হুমকি হচ্ছে, অর্থনীতি এবার ঘুরে দাঁড়াবে ঠিকই, তবে সব দেশে তা সমভাবে হবে না। দেশে-দেশে ও মানুষে-মানুষে বৈষম্য বাড়বে। দেশের জন্য পাঁচ প্রশ্ন তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবার কেমন হবে? দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পর্যায়ে আছে। তবে সেই পুনরুদ্ধার নতুন বছরে কতটা সংহত হবে, নাকি পিছিয়ে পড়বে, তা নির্ভর করছে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তরের ওপর। যেমন মূল্যস্ফীতি কতটা বাড়বে, অমিক্রন কতটা প্রাণঘাতী, প্রণোদনার ঋণ কতটা ব্যাংকে ফিরবে, বিশ্ব বাণিজ্য কেমন থাকবে এবং অর্থ কি বিনিয়োগে যাবে না পাচার হবে। ১. মূল্যস্ফীতি: সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এই হার এখন ৬ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। বাংলাদেশের বেশির ভাগই সীমিত আয়ের মানুষ। করোনা অনেকেরই সঞ্চয় শেষ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে সবচেয়ে কষ্টে পড়বে সীমিত আয়ের সব মানুষ ও নতুন করে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে তারা। ২. অমিক্রনের স্বভাব: অমিক্রনের স্বভাব-চরিত্র জানাটা খুবই জরুরি। কেননা, আরেকটি বিধিনিষেধ সহ্য করার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। ৩. ব্যাংক: আবার প্রণোদনা তহবিলের বড় অংশই ছিল ব্যাংকঋণ। এই অর্থ না ফিরলে তা খেলাপিতে পরিণত হবে, ব্যাংকেরও নতুন বিনিয়োগযোগ্য তহবিলে ঘাটতি পড়বে। আবার যদি প্রভাবশালী মহল থেকে এই ঋণ মওকুফের দাবি ওঠে, তাহলেও বাড়বে নানা ধরনের সমস্যা। কেননা, অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য ভালো রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪. রপ্তানি: সন্দেহ নেই, বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার নির্ভর করে আছে বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর। সরবরাহে বিশৃঙ্খলা এই বিশ্ব বাণিজ্যকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্যে ভালো করছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস প্রবাসী আয়ে শেষ দিকে পিছিয়ে পড়লেও রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার ওপরেই নির্ভর করছে অনেক কিছু। ৫. অর্থ পাচার: আর সবশেষ প্রশ্ন হচ্ছে, কিছু মানুষের হাতে যে অর্থ জমেছে, সেই অর্থের গন্তব্য কোথায়? দেশে বিনিয়োগ হবে নাকি চলে যাবে অন্য কোথাও। সমস্যা হচ্ছে, অর্থমন্ত্রীসহ নির্ধারকেরা জানেনই না কারা অর্থ পাচার করে। সুতরাং ঠেকানোর উপায় নেই। সুতরাং অর্থ পাচারের গতি নিয়েই যত আশঙ্কা। শেষ কথা ২০১৯ সাল যখন শেষ হয় তখন কারওই ধারণা ছিল না ২০২০ সালটি কেমন যাবে। ২০২০ সালের শেষে ধারণা ছিল টিকা আবিষ্কার হওয়ায় ২০২১ সালে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, জীবন আবার স্বাভাবিক হবে। আর ২০২১ সাল যাওয়ার আগে দিয়ে গেছে অমিক্রন, যা অতি দ্রুত ছড়াচ্ছে। তারপরও মানুষের আশা, অমিক্রন ছড়ালেও তা খুব বেশি প্রাণঘাতী হবে না। বর্তমানে বাজারে যে টিকা আছে, তার বুস্টার ডোজেই কাজ হবে। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ সংকট কেটে যাবে, কমবে সব ধরনের পণ্যের দাম, ফলে সত্যিকার অর্থেই জীবন আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আশা কতটা পূরণ হবে, নতুন বছরের দ্বিতীয় দিনেই তা বলা মুশকিল। তারপরও আশা করে যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথই তো বলেছিলেন, ‘আশা করিয়া থাকাই একটা নেশা।’ তবে সবশেষে মাইকেল মধুসূদন দত্তকেই না হয় বেশি স্মরণ করি। তিনি লিখেছিলেন, ‘দিন–দিন আয়ুহীন হীনবল দিন–দিন,—/ তবু এ আশার নেশা ছুটিল না?’