গত ১ ফেব্রুয়ারি তিন শিশুসহ ৭১ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশে উড্ডয়ন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নতুন কেনা ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ ধ্রুবতারা (রেজিস্ট্রেশন নম্বর: এস২-একেডি)। মধ্য আকাশে ক্রুজিং (চলমান) অবস্থায় বৈমানিক ক্যাপ্টেন রুবাইয়াত উড়োজাহাজে ইমার্জেন্সি পাওয়ার দেন। এভিয়েশনের পরিভাষায় এটি মেটাল-টু-মেটাল থ্রাস্ট নামে পরিচিত। মূলত বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে শেষ পন্থা হিসেবে বৈমানিকরা এটি করে থাকেন। তবে একবার ইমার্জেন্সি পাওয়ারে চললে মারাত্মক ক্ষতি হয় ইঞ্জিনের। সে কারণে অবতরণের পর নিয়ম অনুযায়ী বৈমানিককে অবশ্যই ঘটনাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একই সঙ্গে ইঞ্জিন খুলে ওয়ার্কশপে বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজটির কোনোভাবেই উড্ডয়নের সুযোগ নেই। যদিও ১ ফেব্রুয়ারির ওই ঘটনার পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এসব বাধ্যবাধকতার কোনোটিই আমলে নেয়নি। বিজি ৬০১ ফ্লাইটটি সিলেটে অবতরণের পর ক্যাপ্টেন রুবাইয়াত এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করেননি। শুধু তা-ই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত দুটি ইঞ্জিনের ওই উড়োজাহাজটি দিয়েই পরিচালিত হয় সে দিনের সিলেট থেকে ঢাকার ফ্লাইট। ১ ফেব্রুয়ারি বিজি ৬০২ ফ্লাইটটিতে ছিলেন এক শিশুসহ ৪৯ জন যাত্রী। উড্ডয়নের সময় থেকে অবতরণ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তেই ইঞ্জিন বিস্ফোরণের শঙ্কা নিয়েই ফ্লাইটটি পরিচালনা করেছিল বিমান কর্তৃপক্ষ। এমনকি ঢাকায় অবতরণের পরও বিষয়টি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে অবহিত করা হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত উড়োজাহাজ এস২-একেডি দিয়েই পরদিন আবারো ফ্লাইট পরিচালনার প্রস্তুতি চলছিল। তবে শেষ মুহূর্তে উড্ডয়ন অনুমতি বাতিল করে বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। সে সময় থেকে গ্রাউন্ডেড অবস্থায় রয়েছে বিমানের নতুন কেনা ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ ধ্রুবতারা। পরবর্তী সময়ে এস২-একেডি উড়োজাহাজে ঘটা মেটাল-টু-মেটাল থ্রাস্টের (ইমার্জেন্সি পাওয়ার) বিষয়টি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ডি-হ্যালাইড কানাডা (ডিএইচসি) এবং ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান প্র্যাট অ্যান্ড হুইটনি কানাডাকে (পিডব্লিউসি) অবহিত করে বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে পিডব্লিউসি জানায়, ককপিটে পাওয়ার লিভারকে স্বাভাবিক সীমার বাইরে ঠেলে দেয়ার কারণে ডুয়াল ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাদের পর্যবেক্ষণ, এস২-একেডি থেকে উভয় ইঞ্জিনই সরিয়ে ফেলা ও সেগুলো মেরামতের জন্য ওয়ার্কশপে পাঠানো প্রয়োজন। ডিএইচসিও পিডব্লিউসির মতো অনুরূপ মতামত দিয়েছে। সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, এস২-একেডির নির্মাণশৈলী অনুযায়ী জরুরি অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ইমারজেন্সি পাওয়ার ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। ওই দিন কী কারণে বৈমানিক ইমার্জেন্সি পাওয়ার দেয়া হয়েছিল তা জানতে বৈমানিকের দেয়া রিপোর্ট চেয়েছে উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ডি-হ্যালাইড কানাডা। তবে ১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর কোনো রিপোর্ট দেননি বৈমানিক ক্যাপ্টেন রুবাইয়াত। নিয়ম অনুযায়ী, সেফটি রিপোর্টটি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতিটি বৈমানিককেই নিয়মিত প্রশিক্ষণে এসব বিষয় অবহিত করা হয়। বর্তমানে বিমানের ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব পালন করছেন ক্যাপ্টেন রুবাইয়াত। ফলে বিমানের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মান নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তা-ই নয়, এখনো ক্যাপ্টেন রুবাইয়াতকে ফ্লাইট পরিচালনায় অব্যাহত রেখেছে বিমান কর্তৃপক্ষ। গতকালও ঢাকা-সিলেট রুটের ফ্লাইট পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাকে। এ ঘটনার পর বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ একটি তদন্ত করে। উডন্ত অবস্থায় উড়োজাহাজে ইমার্জেন্সি পাওয়ার ব্যবহার করা হয়েছে তাদের পর্যবেক্ষণে তা উঠে আসে। কিন্তু ফ্লাইট ডাটা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ইমার্জেন্সি পাওয়ার পাইলট কী কারণে ব্যবহার করেছেন সেটি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্বাভাবিক এ ঘটনাতে বিমান কর্তৃপক্ষের কোনো ত্রুটি নেই তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে ইঞ্জিন মেরামতের ব্যয়ের কোনো কিছুই বহন করবে না ডি-হ্যালাইড কানাডা (ডিএইচসি)। আর ইঞ্জিন ওয়ার্কশপে নেয়ার আগে খরচের পরিমাণ বলা সম্ভব নয়। পরবর্তী সময়ে করণীয় পন্থা ঠিক করতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে বসে বিমান কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফ্লাইট অপারেশন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্লাইট সেফটির কর্মকর্তারা ১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার বিষয়ে বিজি ৬০১ ফ্লাইটের দায়িত্বে থাকা ক্রুদের বক্তব্য নেয়। এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি টেকনিক্যাল বলে উল্লেখ করেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উড়োজাহাজের বিষয়টি যেহেতু টেকনিক্যাল, সে কারণে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে তথ্য নিয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে।’ যদিও বিমানের সেফটি ডিপার্টমেন্টটি সরাসরি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অধীনে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সদস্য (ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশনস) গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী মো. জিয়াউল কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, বিমানের এস২-একেডি উড়োজাহাজে যে ঘটনাটি ঘটেছে তাতে কোনো পক্ষের ত্রুটি পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বেবিচক।