মোটরসাইকেলের সংখ্যা ক্রমেই কমিয়ে আনছে জাপান। গত এক দশকে দেশটিতে মোটরসাইকেল কমানো হয়েছে কম-বেশি ২৫ লাখ। এর ফলাফলও হাতেনাতে পেয়েছে জাপান। দেশটিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কমে অর্ধেক হয়েছে। বাংলাদেশ হাঁটছে ঠিক এর উল্টোপথে। এখানে মোটরসাইকেল যেমন প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে এ বাহনের দুর্ঘটনাও। বাংলাদেশে যত নিবন্ধিত যানবাহন আছে, তার প্রায় ৭০ শতাংশই মোটরসাইকেল। রাজধানী ঢাকার মোট যানবাহনের অর্ধেক মোটরসাইকেল। সারা দেশে দ্বিচক্র যানটির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সর্বশেষ ছয় বছরে। একই সময়ে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। ১৭ লাখ ৮০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে ঢাকা মহানগর এলাকায়। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৮ লাখ ৯৫ হাজার। তথ্যটি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। ঢাকা মহানগর এলাকা থেকে গত ছয় বছরে নিবন্ধন নিয়েছে ৫ লাখ ১০ হাজার মোটরসাইকেল। অন্যদিকে সারা দেশে নিবন্ধিত ৫০ লাখ মোটরযানের ৩৫ লাখই মোটরসাইকেল। এর মধ্যে ২১ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধন নিয়েছে সর্বশেষ ছয় বছরে। ঢাকাসহ সারা দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, গত ছয় বছরে রাজধানীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে ২০১৬ সালে ঢাকায় ১২৩টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এসব দুর্ঘটনার ৮ শতাংশ হয়েছিল মোটরসাইকেলে। বিপরীতে ২০২১ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা হয় ২৮৯টি। সংঘটিত দুর্ঘটনার প্রায় ২৩ শতাংই হয় মোটরসাইকেলে। সারা দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার চিত্রটি আরো ভয়ংকর। বুয়েটের হিসাব বলছে, ২০১৬ সালে দেশে ১ হাজার ৭৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনার ৮ শতাংশে সম্পৃক্ত বাহন ছিল মোটরসাইকেল। পরের ছয় বছরে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। সর্বশেষ ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় ৪ হাজার ৫১৮টি। এসব দুর্ঘটনার ২৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ হয় মোটরসাইকেলে। মোটরসাইকেলের সংখ্যার সঙ্গে দুর্ঘটনার সংখ্যায় সরাসরি যোগসূত্র থাকার কথা জানিয়েছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল যত বাড়বে, ততই বাড়বে সড়ক দুর্ঘটনা। বিষয়টি দেশে দেশে পরীক্ষিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশে মোটরসাইকেল চলাচলের উপযোগী সড়ক অবকাঠামো নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকাসহ দেশের সড়কগুলোয় মোটরসাইকেল চালানোর জন্য আলাদা কোনো লেন নেই। সড়কে অন্যান্য ভারী যানবাহনের সঙ্গে দুই চাকার বাহনটি চালানো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। পাশাপাশি মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে যে ধরনের ‘সেফটি গিয়ার’ পরিধান করতে হয়, বাংলাদেশের মোটরসাইকেল আরোহীরা তার সঙ্গে পরিচিতই নন। ফলে এখানে সামান্য দুর্ঘটনাতেই হতাহত বেশি হচ্ছে। দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার জন্য সরকারের নীতিগুলোও ভূমিকা রাখছে। মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক ছাড়, নিবন্ধন ফি কমানোসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা মানুষকে মোটরসাইকেল কিনতে উৎসাহী করছে। দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখনই এ সংখ্যায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াবে। দেশে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে বুয়েটের বিশ্লেষণ বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো সবচেয়ে বেশি হচ্ছে পেছন থেকে ধাক্কায়। মোট দুর্ঘটনার ৪২ শতাংশই অন্য যানবাহন মোটরসাইকেলকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার ফলে ঘটছে। একইভাবে ১৪ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে মুখোমুখি সংঘর্ষে। আরো ১৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে। অন্যদিকে ওভারটেক করতে গিয়ে ১০ শতাংশ, সংঘর্ষে ৯ শতাংশ, সড়কের কোনো অবকাঠামোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে ৩ শতাংশ, পার্ক করে রাখা যানবাহনকে ধাক্কা দিয়ে ২ শতাংশ ও ৬ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে অন্য কারণে। মোটরসাইকেলকে কোনোভাবেই নিরাপদ বাহন মনে করেন না পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, মোটরসাইকেল কখনই নিরাপদ বাহন নয়। বাণিজ্যিকভাবে যখন ব্যবহার হয়, তখন এগুলো আরো অনিরাপদ হয়ে ওঠে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে। মোটরসাইকেলচালকদের ট্রাফিক পুলিশও অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দুই চাকার গাড়ির ক্ষেত্রে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য মোটরসাইকেলের সংখ্যায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বললেও বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার তাতে খুব একটা সমাধান দেখছেন না। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় হতাহত বেড়েছে, এটা সত্য। কিন্তু আমরা যদি দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব, দুর্ঘটনার শিকার মোটরসাইকেলের একটা বড় অংশের চালক অপ্রাপ্তবয়স্ক। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার পরও এ অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছেন তাদেরই অভিভাবকরা। তাই মোটরসাইকেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেয়ে জরুরি হচ্ছে সচেতনতা। অভিভাবকরা সচেতন হবেন, মোটরসাইকেলচালক ও আরোহীদেরও সচেতন হতে হবে এবং ট্রাফিক আইন-কানুন মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আমাদেরও ভূমিকা রাখতে হবে এবং সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা সেই ভূমিকা রেখে যাচ্ছি। ভ্রাম্যমাণ আদালত ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও পরিচালনা করছি।