প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, অর্থ না বুঝে কুরআন তেলাওয়াতে কোন উপকার হবে কি না? কেউ বলে থাকে অর্থ না বুঝে কুরআন তেলাওয়াত করলে কোন উপকার হবে না। আবার কেউ এটাকে প্রেসক্রিপশনের সাথে তুলনা করে বলেন, ঔষধ ক্রয় না করে প্রেসক্রিপশন পাঠ করলে যেমন কোন উপকার হবে না, তেমনি অর্থ না বুঝে কুরআন তেলাওয়াত করলেও কোন উপকার হবে না। এরূপ মন্তব্য সঠিক নয়, বরং এটা কুরআনের সাথে চরম ধৃষ্টতা বৈ কিছু নয়। কারণ কুরআন-হাদীছের অনেক প্রমাণ দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, অর্থ না বুঝলেও কুরআন তেলাওয়াত বিফলে যাবে না। বরং তেলাওয়াতকারী প্রত্যেক অক্ষরে দশটি করে নেকী প্রাপ্ত হবে। কুরআন তেলাওয়াতের ফযীলতের যত হাদীছ আছে, এগুলোর কোথাও অর্থ বুঝে পড়ার শর্ত আরোপ করা হয়নি। উপরন্তু কুরআনে অনেক আয়াত এমন আছে, যেগুলোর অর্থ সকল মুফাসসিরের ঐক্যমতে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ জানে না। যেমন হুরুফে মুক্বাত্বা’আত। যথা: - আলিফ লা-ম মীম, ত্বোয়া-হা, হা-মীম ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো, প্রায় প্রত্যেক সূরার শুরুতে বিদ্যমান এরূপ অক্ষরগুলো তেলাওয়াত করলে কি কোন ছওয়াব হবে না? বরং হাদীছে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ‘আলিফ লা-ম মীম’ পড়লে ত্রিশটি নেকী পাবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাজিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لاَ أَقُولُ الْم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ. ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের কোন একটি অক্ষর পাঠ করবে, তার বিনিময়ে সে একটি নেকী পাবে, আর একটি নেকী দশ নেকীর সমান হবে। আমি ‘আলিফ লাম মীম’ কে একটি অক্ষর বলছি না, বরং ‘আলিফ’ একটি অক্ষর, ‘লাম’ একটি অক্ষর এবং ‘মীম’ একটি অক্ষর’। (সুতরাং তেলাওয়াতের নিয়তে ‘আলিফ লাম মীম’ বললে ত্রিশটি নেকী পাওয়া যাবে)। এ কারণেই সালাফে ছালেহীন বলেছেন, কুরআনের অর্থ বোধগম্য হোক বা না হোক, সেমতে আমল করুক বা না করুক কুরআন তেলাওয়াতকারী অবশ্যই ছওয়াব প্রাপ্ত হবে। তবে বুঝে আমল করার ছওয়াব অনেক বেশী। সুতরাং কোন অবস্থাতেই কুরআন তেলাওয়াত পরিত্যাগ করো না। এছাড়া কুরআন মাজীদকে প্রেসক্রিশনের সাথে তুলনা করা ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের শামিল এবং সঠিক জ্ঞানের দৈন্যদশার অন্তর্গত। কারণ কুরআন নিজেও তো মহাঔষধ। স্বয়ং কুরআন নিজেও নিজেকে ‘শিফা’ অর্থাৎ রোগ থেকে মুক্তি বলে আখ্যায়িত করেছে। এর জন্য সূরা ইউনুস আয়াত নং ৫৭, يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ‘হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবানী এসেছে তামাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়াত ও রহমত মুসলমানদের জন্য’। সূরা বনী ইসরাঈল আয়াত নং ৮২, وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا ‘আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গোনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়’। সূরা হা-মীম সাজদা, আয়াত নং ৪৪ وَلَوْ جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا أَعْجَمِيًّا لَقَالُوا لَوْلَا فُصِّلَتْ آيَاتُهُ أَأَعْجَمِيٌّ وَعَرَبِيٌّ قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ فِي آذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًى أُولَئِكَ يُنَادَوْنَ مِنْ مَكَانٍ بَعِيدٍ ‘আমি যদি একে অনারব ভাষায় কুরআন করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলত, এর আয়াতসমূহ পরিষ্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চার্য যে, কিতাব অনারব ভাষায় আর রসূল আরবী ভাষী! বলুন, এটা বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়াত ও রোগের প্রতিকার। যারা মুমিন নয়, তাদের কানে আছে ছিপি, আর কুরআন তাদের জন্য অন্ধত্ব। তাদেরকে যেন দুরবর্তী স্থান থেকে আহবান করা হয়’। বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। উল্লেখিত আয়াতগুলো একথার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, কুরআন নিজেই শেফা। সুতরাং কুরআনকে প্রেসক্রিপশনের সাথে তুলনা করা ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ বৈ কিছু নয়। এছাড়া হাদীছেও কুরআন কে বিশেষ করে সূরা ফাতেহা কে ‘শেফা’ বলা হয়েছে। এছাড়া আরো ভাবার বিষয় হল, আল্লাহ তাআলা কুরআন তেলাওয়াতকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৌলিক দায়িত্বগুলোর অন্তর্ভূক্ত করে দিয়েছেন। সেখানেও অর্থ বুঝেই তেলাওয়াত করতে হবে সেরূপ কোন শর্ত লাগানো হয়নি। মোট কথা, অর্থ বুঝে আসুক বা না আসুক, আল্লাহর কালামকে তেলাওয়াত করা মহৎ একটি ইবাদত ও মহা পুণ্যের কাজ। প্রতিটি অক্ষরে দশটি করে নেকী। যেমন কোন মর্ম বা ব্যাখ্যা না বুঝে ঔষধ সেবনে রোগীর উপকার হয়, তদ্রুপ অর্থ বা তাফসীর না বুঝে কুরআন তেলাওয়াত করলেও মুমিনের জন্য অনেক উপকার সাধন হয়। সুতরাং যারা অর্থ পুরাপুরী বুঝে না, তারা কুরআন তেলাওয়াত থেকে মাহরুম থাকার কোন কারণ নেই। বরং আপনারা নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকবেন। (সূত্রঃ কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? পৃষ্ঠা ১৭৪-১৭৭) মুহাম্মদ হারুন আজিজী নদভী