ডা. মেহমেদ ওয্ তুর্কি বংশোদ্ভূত আমেরিকান কার্ডিওথোরাসিক সার্জন। সফল চিকিৎসক-জীবনে পাঁচ হাজারেরও বেশি ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন তিনি। হৃদরোগীদের জীবনকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। বিপুল এ অভিজ্ঞতার আলোকে গত প্রায় এক দশক ধরে হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা ও সর্বোপরি সুস্থ জীবনের জন্যে বিজ্ঞানসম্মত খাদ্যাভ্যাসের ধারণাকে তিনি তুলে ধরেছেন তার লেখা একাধিক বই ও টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আমেরিকার জনপ্রিয় স্বাস্থ্য-বিষয়ক টিভি অনুষ্ঠান ‘ডা. ওয্ শো’-এর সঞ্চালক খ্যাতিমান এ চিকিৎসক বছর কয়েক আগে টাইম ম্যাগাজিনে 'What to eat now' শীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখেন— একসময় বলা হতো, সার্জনের দিন ভালো হলে অপারেশনের পর রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন; আর দিন খারাপ হলে দুর্ভাগ্যই বটে, হতে পারে তা রোগীর মৃত্যুও। কিন্তু হৃদযন্ত্রের ব্লকেজ-আক্রান্ত অসংখ্য রোগীকে অপারেশনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি ও আমার সহকর্মীরা দেখেছি, করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সার্জনের ছুরির নিচে যারা বুক পেতে দিতে বাধ্য হন এবং বাইপাসের পরও যন্ত্রণাকাতর দিন কাটান তাদের ভোগান্তির অন্যতম প্রধান কারণ একটাই। ভুল খাদ্যাভ্যাস। মজার ব্যাপার হলো, খাদ্যের সহজলভ্যতা ও অতিভোজন আমেরিকার মতো দেশগুলোতে স্বাস্থ্যবান জাতির বদলে উপহার (!) দিয়েছে মেদস্থূলতা হৃদরোগ ডায়াবেটিস ইত্যাদি প্রাণসংহারী রোগে আক্রান্ত একটি অসুস্থ জাতি। এ রোগগুলো ইতোমধ্যেই সেখানে প্রায় মহামারিতে রূপ নিয়েছে। আমেরিকানদের মধ্যে বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ পূর্ণবয়স্ক ও এক-তৃতীয়াংশ শিশু-কিশোর হাঁসফাঁস করছে মেদস্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের ভারে। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আমি আজ পর্যন্ত এমন কাউকে পাই নি, যিনি স্বেচ্ছায় আমার ছুরির নিচে এসেছেন কিংবা আসতে পেরে আনন্দিত হয়েছেন। আসলে নিজের বুকে ছুরি-কাঁচি চালাতে কেউই চান না, কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে বাইপাস সার্জারির দ্বারস্থ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণটি হলো বিজ্ঞানসম্মত ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে অধিকাংশ মানুষের অজ্ঞতা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রভাবে বর্তমানে আমরা স্বাস্থ্যকর খাবারটি বেছে নেয়ার বদলে স্বাস্থ্যঘাতী খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু এখন সময় এসেছে সুস্থতার জন্যে প্রয়োজনীয় ও উপকারী খাবারটি বেছে নেয়ার। এজন্যে দুর্লভ কোনো খাবারের সন্ধান করার প্রয়োজন নেই বরং পর্যাপ্ত তাজা ফলমূল, সালাদ, আঁশযুক্ত শাক-সব্জি এবং কম চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করে একজন মানুষ অনায়াসে সুস্থ থাকতে পারেন। আর শত সহস্র বছর ধরে আমাদের শরীরও এসব খাবারেই সুস্থ থাকতে অভ্যস্ত। এর ফলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস-এর মতো জীবনঘাতী রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকাসহ শরীরের ওজনও থাকে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও হয়ে ওঠে কার্যকরী ও পূর্ণ কর্মক্ষম। খাবারে অতিরিক্ত লবণ এবং পাতে লবণ বর্জনীয়—এটুকু আমরা সকলেই জানি। কিন্তু আরো একটু সচেতনতা এক্ষেত্রে জরুরি। বাজারে প্রক্রিয়াজাত যেসব খাবার পাওয়া যায় সেগুলোকে আকর্ষণীয়, স্বাদযুক্ত ও মুখরোচক করে তোলার জন্যে তাতে মেশানো হয় অতিরিক্ত পরিমাণ লবণ, যা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্যে ভীষণ স্বাস্থ্যহানিকর। আর দিনের পর দিন অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন যারা, তাদের খাবারে শুধু লবণ নিয়ন্ত্রণ করেও অনেক ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। মুটিয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকে দুধ খেতে চান না। কেউ-বা আবার বেছে নেন ফ্যাটমুক্ত স্কিম্ড মিল্ক। কিন্তু ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এ দুয়ের মধ্যে আসলে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বরং দুধের ক্যালসিয়াম পরিপাকতন্ত্রে থাকা অন্যান্য খাবারের সাথে বিক্রিয়া করে বলে শরীর কর্তৃক তুলনামূলক কম ফ্যাট শোষিত হয়। অবশ্য সব খাবারই হওয়া চাই পরিমিত। অনেকে আছেন যারা কফির প্রতি অনুরক্ত কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত কফি আপনাকে স্নায়বিকভাবে দুর্বল করে তুলতে পারে। যথাসম্ভব প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হোন। এগুলো একদিকে যেমন সহজলভ্য, তেমনি আপনার চারপাশে সহজেই এদের দেখা মেলে। উপকারী তো বটেই। আর বর্জন করুন সব ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবার ও ফাস্টফুড। স্ন্যাক্স হিসেবে বিভিন্ন ধরনের বাদাম খান। বাদাম ও ফ্রেঞ্চফ্রাই-এর মধ্যে একটি তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গেছে, বাদাম খেলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে আর ফ্রেঞ্চফ্রাই ওজন বাড়ায়। নিয়মিত বাদাম খেলে শরীরের জন্যে উপকারী কোলেস্টেরল এইচডিএল-এর পরিমাণ বাড়ে ও ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে। আপনার খাদ্যতালিকায় যতদূর সম্ভব কমিয়ে দিন রেড মিট অর্থাৎ গরু ছাগল মহিষ ভেড়া ইত্যাদির গোশত। এর বদলে খান সামুদ্রিক মাছ। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ বলে এটি আপনার মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডের জন্যে উপকারী। এন্টি-অক্সিডেন্টযুক্ত পর্যাপ্ত খাবার যেন থাকে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায়। তাতে আপনার বার্ধক্যের গতি হবে ধীর। সেইসাথে বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতা, পার্কিনসন্স এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থেকে আপনি বেঁচে যাবেন। বেশ কয়েক বছর ধরে পাশ্চাত্যসহ সারা বিশ্বেই প্রক্রিয়াজাত খাবার বিপণনের ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে এক নতুন হুজুগ—‘ফ্যাট ফ্রি’। যারা এসব কিনছেন তারা কি আদৌ জানেন যে, তারা আসলে কী খাচ্ছেন? এসব খাবারের ফ্যাট সরিয়ে তা স্বাদযুক্ত করতে এতে ব্যবহার করা হয় অতিরিক্ত চিনি, লবণ (সোডিয়াম) ও আরো অনেক কিছু, যা ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই ‘ফ্যাট ফ্রি’ মানেই যে খুব উত্তম খাদ্য তা মনে করার কোনো কারণ নেই, বরং এসব খাবার আপনাকে অসুস্থ ও মেদস্থূল করে তুলতে পারে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে আপনি কতটা খাচ্ছেন তার চেয়েও কী খাচ্ছেন তা ঢের গুরুত্বপূর্ণ। চার বছর ধরে সোয়া লক্ষ মানুষের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছেÑফ্রেঞ্চফ্রাই, চিপ্স, বিভিন্ন রকম পানীয়, মিষ্টি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার ওজন বাড়ায়। অন্যদিকে বাদাম, টক দই, তাজা ফলমূল, আঁশ-জাতীয় শাক-সব্জি এবং পূর্ণ শস্যদানা জাতীয় খাবার ওজন কমায়। খাদ্যতালিকায় এ খাবারগুলো থাকলে প্রতি গ্রাসেই আপনি পাবেন শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও সব ধরনের খাদ্য-উপাদান। আর আঁশসমৃদ্ধ খাবার পাকস্থলীতে দীর্ঘক্ষণ থাকে বলে এটি তুলনামূলক ধীরে হজম হয়। তাই ক্ষিদেও লাগে একটু দেরিতে। এ কারণে মূল খাবারের কিছুটা আগে কোনো একটি ফল ও মুঠোভর্তি বাদাম খেয়ে নিন। ক্যালরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন খুব সহজেই। ওজন নিয়ন্ত্রণ ও সর্বোপরি সুস্থতার জন্যে ব্যায়ামের ভূমিকা নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন’-এর মতে, সপ্তাহে নিদেনপক্ষে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম সুস্থতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যেমন, প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট করে হাঁটা। কিংবা জগিংও চলতে পারে। ওজন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এটি পরিপাকতন্ত্রকেও শক্তিশালী করে তুলবে। আসলে সুস্থ দেহ, পরিমিত ওজন ও রোগমুক্ত সুন্দর জীবনের জন্যে আমাদের অনেক কঠিন কিছু করার প্রয়োজন নেই বরং ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ নিলেই আমাদের জীবন হয়ে উঠতে পারে চমৎকার ছন্দময় ও কর্মমুখর; তা হলো—প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হোন, পরিমিত খান এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন। তথ্যসূত্র : টাইম ম্যাগাজিন