একটি বই পড়েছিলাম— ম্যান’স সার্চ ফর মিনিং। লিখেছেন গত শতাব্দীর একজন খ্যাতনামা মনোবিদ ডা. ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল। অস্ট্রিয়ার এই নিউরোলজিস্ট ও সাইকিয়াট্রিস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে সপরিবারে বন্দি হন এবং তিন বছরের বন্দিদশা থেকে বেঁচে ফেরার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে তিনি এ বইটি লেখেন। বইটিতে তিনি বলেছেন, জীবন হচ্ছে একটা বিয়োগান্তক আশাবাদ (Tragic optimism)। কেন ট্র্যাজিক? কারণ এই জীবনে ভোগান্তি আছে। পাপবোধ আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই জীবনে মৃত্যু আছে। তারপরও আমরা সবাই কিন্তু বাঁচতে চাই। জীবনকে উপভোগ করতে চাই। মনস্তত্ববিদ ফ্রয়েডের মতে, জীবনে শক্তির উৎস হচ্ছে আনন্দ-ফূর্তি। হিটলারের মতে, এর উৎস হলো ক্ষমতা। কিন্তু ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল বলছেন, জীবনে শক্তির উৎস হচ্ছে আসলে মমতা ও ভালবাসা। রুমির একটা কথা আছে, যার মর্মার্থ হলো ‘নৈঃশব্দ্য হলো স্রষ্টার ভাষা।’ এখানে এলে আমার এই নৈঃশব্দ্যের মধ্যেই থাকতে ইচ্ছে করে। বোঝার চেষ্টা করতে ইচ্ছে হয় স্রষ্টার ভাষাটা আসলে কী, তিনি কী বলছেন আমাদের। হয়তো এটা বুঝলেই আমরা কিছুটা অনুভব করতে পারব যে, কী অপূর্ব মমতায় তিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং আমাদের সৃষ্টি করেছেন! এবার লামায় আসার পর থেকে এসব কথাই ভাবছিলাম। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শতাধিক চিকিৎসক এখানে সমবেত হয়েছেন, যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে আগ্রহী। চিকিৎসা ব্যবস্থার কিছু দিক নিয়ে এখন একটু বলতে চাই। ঢাকা শহরের কথাই ধরি। ছোট-বড়, সাধারণ, কর্পোরেট কত ধরনের অগণিত ক্লিনিক-হাসপাতালই তো আছে। কিন্তু খোদ ঢাকা শহরের সর্বস্তরের মানুষের প্রয়োজন কি তাতে মিটেছে? প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা বলতে আমরা যা বুঝি তার কতটুকু তারা পাচ্ছে? প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগের পক্ষ থেকে ঢাকার কড়াইল বস্তিতে আমরা একটি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করি। নিরাময়-অযোগ্য, মৃত্যুপথযাত্রী, শয্যাশায়ী, প্রবীণ আর প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্যে স্বল্প পরিসরে পরিচালিত একটি প্রকল্প এটি। বিএসএমএমইউ থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্ব। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি নানারকম রোগে ভুগে কী ভোগান্তি, কষ্ট আর দুর্দশায় দিন কাটায় ওখানকার মানুষ! একটু রূঢ় ভাষাতেই বলছি স্বাস্থ্যসেবাকে প্রায় পণ্যে পরিণত করেছি আমরা। ফলে বিষয়টা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই পণ্যটা আমি কোত্থেকে কিনব। চোখ ধাঁধানো সুপারশপ থেকে নাকি পাড়ার মুদি দোকান থেকে? ঠিক এরকম একটি পর্যায়ে আছি এখন আমরা। আমরা যখন ডাক্তার হলাম, আশির দশকের শুরুতে, আল্ট্রাসনোগ্রামের যুগ মাত্র শুরু হলো। এর পরে এলো সিটি স্ক্যান, এমআরআই আরো কত কী! এখন হরদম প্রেসক্রিপশনে লেখা হচ্ছে পেট-সিটি (PET-CT)। ৬২ হাজার টাকা যার খরচ! জানি না এর শেষ কোথায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে একটি মর্যাদাপূর্ণ সাময়িকী হলো ল্যানসেট। দুবছরব্যাপী তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও গবেষণার পর ল্যানসেট কমিশন সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গত বছরের ২৫ জুন এই রিপোর্ট যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সর্বদলীয় কমিটির কাছে হস্তান্তর করা হয়, সে অনুষ্ঠানে আমারও থাকার সুযোগ হয়েছিল। রিপোর্টের মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা পৃথিবীব্যাপী মানুষের ভোগান্তি কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলি, ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি বড় বড় হাসপাতালের মিলিত উদ্যোগে কিছু চিকিৎসা-গবেষণা পরিচালিত হয়। সাপোর্ট স্টাডি শিরোনামে এ গবেষণা প্রতিবেদনগুলো যে চিকিৎসা-সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় তার বিজ্ঞ সম্পাদক চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন সম্পাদকীয়তে— ‘গত শতাব্দীজুড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তাতে বোধহয় আমরা কেবল একটি জিনিসই রোগীদের উপহার দিতে শিখেছি, তা হলো, হাই টেকনোলজি ডেথ!’ শব্দটা আমাকে বেশ আলোড়িত করেছিল সে-সময়। পরবর্তীকালে অসংখ্যবার আমার মনে হয়েছে, আমাদের চোখের সামনে দিয়ে এই হাই টেকনোলজি ডেথটাই বার বার ঘটে চলেছে এবং আমি-আপনি কেউই হয়তো এ থেকে মুক্তি পাব না। আমরা চিকিৎসকরা যেন এই জায়গাটায় নজর দিতে চেষ্টা করি। রোগীদের ভোগান্তি কমানো কিংবা হাই টেকনোলজি ডেথ এড়ানোর ব্যাপারে আমরা যেন যথার্থই সচেতন হই। এখানে আমার বয়োকনিষ্ঠ চিকিৎসক যারা আছেন, মূলত তাদের উদ্দেশ্যে আমি এ কথাগুলো বলছি। তাদের প্রতি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ— আমরা যেটা পারি নি, আপনারা সেটা করুন। চিকিৎসার সাথে মমতা ও ভালবাসার মেলবন্ধন ঘটান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বছর কয়েক আগে গাইবান্ধায় একটা গবেষণা হয়েছিল। সে রিপোর্টে এসেছে চিকিৎসাব্যবস্থার কিছু নির্মম সত্য। চিকিৎসকরা রোগী প্রতি গড়ে মাত্র ১৯ সেকেন্ড সময় দেন এবং প্রতি ১৩ সেকেন্ড পর পর তারা রোগীকে থামিয়ে দেন। কথা বলতে দেন না। চিকিৎসকরা হয়তো আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলবেন, ‘এ-ছাড়া কী করার আছে? শোনার সময়ই তো নাই’। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, সময় নেই এটা সত্য, কিন্তু সবচাইতে বড় সত্য না। আসলে আমাদের ভেতর থেকে কথা শোনার এবং বলার প্রবণতাও হারিয়ে যাচ্ছে। সময় থাকলেও আমরা এখন কথা বলি না। সময় থাকলেও আমরা মমতা-ভালবাসার প্রকাশ ঘটাই না। আমাদের সবার ভেতরে ভালো চিকিৎসক শুধু নয়, একজন ভালো মানুষ জন্ম নিক। মমতা ও ভালবাসার প্রকাশ ঘটুক। ভালবাসার মধ্য দিয়ে আমাদের হৃদয় আরো প্রস্ফুটিত হোক, যাতে আমরা মানুষকে আরো বেশি সেবা ও ভালবাসা দিতে পারি। জীবনের উদ্দেশ্য তো তা-ই! (ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ারের অধ্যাপক। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মেডিকেল ক্যাম্পে দেয়া বক্তব্য থেকে নেয়া।)