হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় অরাজনৈতিক আধ্যাত্মিক সংগঠন। শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। মৃত্যু অবদি তিনি এই সংগঠনের আমীরের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শাইখুল ইসলামের ইন্তেকালের পর তাঁর এই মহান আমানত তার উত্তরসুরী ওলামায়ে কেরামের হাতে ন্যস্ত হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি তারই দেখানো পথে এই সংগঠনকে পরিচালিত করতে। তিনি বলেন, হেফাজত শুরুর দিন থেকেই সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন। হেফাজতের কোনও রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। হেফাজতের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। হেফাজতের প্রধান প্রধান পদগুলোতে যারা রয়েছেন, তারাও সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। বিশেষ করে বর্তমান আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী, প্রধান উপদেষ্টা আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী এবং আমি, আমরা কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না এবং বর্তমানেও নেই। আল্লামা নুরুল ইসলাম বলেন, হেফাজত শুধু দ্বীনি ইস্যুতে কর্মসূচী দিয়ে থাকে। এযাবতকাল আমরা যতগুলো কর্মসূচী দিয়েছি, তার সবগুলোই দ্বীন ও দেশের স্বার্থে। আজ (২২ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। তিনি বর্তমান পরিস্থির বিষয়ে বলেন, দেশে বর্তমান যে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে। হেফাজত মোদীর সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেছে। এটা কোনও রাজনৈতিক ইস্যু বা দেশ বিরোধিতা নয়। অতীতে অনেকবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফর করেছেন। আমরা তখন বিরোধিতা করিনি। মোদীর আগমন বিরোধিতার কারণ, তার ইসলাম বিদ্বেষ। মোদী এবং তার দল ভারতের মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির নির্মাণ করছে। কাশ্মীরে মুসলিম গণ-হত্যা ও জনগনের অধিকার হরণ করছে। এসব কারণেই আমরা মোদীর আগমনের বিরোধিতা করেছি। তবে সেই বিরোধিতা বক্তব্য ও বিবৃতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো। হেফাজত মাঠের কোনও কর্মসূচী দেয়নি। বরং সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, এই ইস্যুতে আমাদের কোনো কর্মসূচী নেই। বিশেষ করে ২৬ মার্চ দেশের কোথায় হেফাজতে ইসলামের কোনও কর্মসূচী ছিলো না। হেফাজত মহাসচিব বলেন, কিন্তু ২৬ তারিখ জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমে সাধারণ মুসল্লিদের সাথে কিছু দুষ্কৃতিকারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এতে সাধারণ মুসল্লিদের অনেকেই আহত হয়। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হাটহাজারী ও বি-বাড়ীয়ায় বিক্ষোভ করে সাধারণ ছাত্র জনতা। এরই পরিপেক্ষিতে হেফাজত দুই দিনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী ঘোষণা করে। ২৭ মার্চ ছিলো বিক্ষোভ সমাবেশ ও ২৮ মার্চ শান্তিপূর্ণ হরতাল। আল্লামা নুরুল ইসলাম বলেন, হেফাজতের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে শান্তিপূর্ণ ভাবে কর্মসূচীগুলো বাস্তবায়ন করতে। এবং যেখানে যেখানে নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন, সেখানে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়নি। তবে যেসব জায়গায় নেতৃবৃন্দ সশরীরে উপস্থিত হতে পারেননি, এমন কিছু জায়গায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নই এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পিছনের আসল ঘটনা কি! কারণ আমরা তো বারবার বলেছি আমাদের কর্মসূচী হবে শান্তিপূর্ণ। তাহলে কারা করলো এসব বিশৃঙ্খলা! হতে পারে কোনো কোনো অপশক্তি তাদের হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষে হেফাজতের শান্তিপূর্ণ কর্মসুচীতে অনুপ্রবেশ করেছিলো এবং হেফাজত ও হেফাজতের নেতাকর্মীদের দায়ী করার জন্য নানান বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। তিনি বলেন, সরকারের উদ্দেশ্যে আমরা স্পষ্ট বলতে চাই। ২৬ তারিখ আমাদের কর্মসূচী ছিলো না। বাইতুল মোকাররমে যারা বিক্ষোভ করেছে, তাদের সাথে হেফাজতের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং সে ঘটনায় পরিস্থিতি শান্ত করতে ভূমিকা রেখেছে হেফাজত। হেফাজতের দায়িত্বশীলরা সেদিন প্রশাসনের অনুরোধে মসজিদ থেকে বিক্ষোভরত মুসল্লিদের বের করে নিয়ে আসে। হাটহাজারীতে যে বিক্ষোভ হয়েছে, সেটাও কেন্দ্র ঘোষিত কোনও কর্মসূচী ছিলো না। সেটা ছিলো ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ। শুক্রবার হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ২৭ তারিখ বিক্ষোভ হেফাজতের ঘোষিত কর্মসূচী হলেও আমরা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত কর্মসূচী পালন করতে সক্ষম হয়েছি। দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কোথাও কোনও ঝামেলা তৈরি করতে দেওয়া হয়নি। ২৮ তারিখ হেফাজতের হরতাল কর্মসূচী ছিলো। বারবার সংবাদ সম্মেলন করে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচী পালন করতে আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। নেতৃবৃন্দ মাঠে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচী পালন করেছে। নেতৃবৃন্দ থাকা অবস্থায় কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়নি। হেফাজত মহাসচব বলেন, বি. বাড়িয়াসহ কয়েকটি জায়গায় বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেছে। সে ঘটনার সাথে হেফাজতের হরতাল কর্মসূচী সরাসরি কোনও সম্পর্ক ছিলো না। ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসায় হামলা করায় বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ মাঠে নেমে আসে, এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। হেফাজত মহাসচিব আরো বলেন, আমরা সরকারের কাছে আহবান জানাবো, মাদরাসায় হামলা ও তৌহিদি জনতাকে উস্কানি দেওয়ার পিছনে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করুণ। এ ঘটনার সাথে কোনো তৃতীয় পক্ষ যদি জড়িত থাকে, আপনারা তদন্ত করে বের করুণ। এতে আমরাও সহযোগিতা করবো ইন শা আল্লাহ। তারপরেও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা সমূহের জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। এ ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দের আরো সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিলো বলে আমরা মনে করি। আগামীতে হেফাজতের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এসব ক্ষেত্রে আরো সতর্ক থাকবে ইন শা আল্লাহ। আল্লামা নুরুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিন যাবত গণহারে হেফাজত নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করছে প্রশাসন। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা জুনাইদ আল হাবীব, কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সেক্রেটারি মাওলানা মামুনুল হক, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, মাওলানা খোরশেদ আলম কাসেমী, মুফতী সাখাওয়াত হুসাইন রাজী ও মাওলানা জালাল আহমদ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ঢাকা মহানগর সহসভাপতি মাওলানা যুবায়েদ আহমদ, কেন্দ্রীয় সহকারী অর্থ সম্পাদক মুফতী ইলিয়াস হামিদী, কেন্দ্রীয় সহকারী প্রচার সম্পাদক মুফতী শরীফউল্লাহসহ অসংখ্য নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা সরকারের কাছে জানতে চাই, কেনো তাদের গ্রেপ্তার করা হলো। তারা তো কোনও সহিংসতার সাথে জড়িত ছিলো না। বরং তারা বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন, সরকারের প্রতি আমাদের আহবান, দেশের শান্তি শৃঙ্খলা আমরাও চাই, আপনারাও চান। আমরা কোনোভাবেই চাই না যে, দেশের মধ্যে অশান্তি তৈরি হোক। তাই আসুন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কোনও সমস্যা থাকলে তার সমাধান করি। হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে সারা দেশের নেতাকর্মীরা কর্মসূচী চায়। কিন্তু আমরা দেশের করোনা পরিস্থিতি ও পবিত্র রজমান মাসের সম্মানে কোনও কর্মসূচী দিচ্ছি না। সরকারকে বলব- আপনারা যেমন চাননি দেশে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হোক, আমরাও সেটা চাইনি। কিন্তু এরপরেও কিছু বিশৃঙ্খলা হয়েছে। এবং এতে আমাদের ২২টি তাজা প্রাণ ঝরে গিয়েছে। এতকিছুর পরেও আমরা চুপ রয়েছি। কারণ আমরা দেশ ও দেশের জনগণকে ভালোবাসি। দেশের তৌহিদি জনতাই আমাদের কর্মী। এই অবস্থায় নতুন কোনো কর্মসূচী দিয়ে দেশের পরিস্তিতি আরো নাজুক করতে চাই না। হেফাজত মহাসচিব বলেন, আমরা সরকারের উদ্দেশ্যে বলবো, কোথাও যদি কোনও সমস্যা হয়ে থাকে কিংবা হেফাজতের কর্মসূচীতে তৃতীয় কোন শক্তি যদি সুযোগ নিয়ে থাকে, অথবা কেউ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে থাকে, তাহলে সরকার তাদের খুঁজে বের করুক। আমরা সরকারকে এই ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবো ইন শা আল্লাহ। তিনি বলেন, আসুন এই পবিত্র রমজান মাসে গণ-গ্রেপ্তার বন্ধ করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজি। সমস্যা যত বড়ই হোক, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান বের করা সম্ভব ইন শা আল্লাহ। হেফাজতের মধ্যেও যদি কেউ অপততপরতা চালায়, আমরা তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যাবস্থা নেবো ইন শা আল্লাহ। আল্লামা নুরুল ইসলাম বলেন, দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলবো, আমরা কোনো বিশৃঙ্খলা চাই না। আমরা চাই না আমাদের কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিয়ে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করুক। বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাস চলছে। এই মাস মুসলমানদের ইবাদাতের মাস। এছাড়াও করোনার ভয়াবহতা চলছে। এই অবস্থায় আমরা কোনও কর্মসূচী দিচ্ছি না। আপনারা ধৈর্য ধরুন। নিশ্চই আল্লাহতা’আলা ধৈর্যধারণকারীদের সাথে রয়েছেন। আমরা আশা করছি দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে ইন শা আল্লাহ। সবাই মহান আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দুয়া করুন। ইফতারির পূর্বমুহূর্তে দুয়া কবুল হয়। পবিত্র রমজান মাসে আমরা মাঠে কোনও কর্মসূচী দিতে চাচ্ছি না। দুয়াই আমাদের সবচেয়ে বড় কর্মসূচী। বিশেষ করে হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও মহানগরের আটক নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তির জন্য দোয়া করি। আমিন ইয়া রব্বাল আলামিন। বিবৃতিতে আরো সম্মতি জানিয়েছেন হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, হেফাজতের উপদেষ্টা দেওনার পীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা সাজিদুর রহমান ও মাওলানা আবুল কালাম।