ইসলামের ইতিহাস ও বিশ্ব নবীর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো মেরাজ। মুসলিম উম্মাহর জন্যও এক অভূতপূর্ণ নেয়ামত। মেরাজ একদিকে যেমন নবীজির অন্যতম মুজেযা ও অনন্য শ্রেষ্ঠত্ব তেমনিভাবে এটি তাঁর উম্মতের জন্যও অনেক গুরুগম্ভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাই প্রতিটি মুসলিমের জন্য তার ওপর বিশ্বাস রাখা ইমানের অংশ। স্বয়ং আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন-‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে (সে রাতে) আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা ইসরা : আয়াত ১) মেরাজ কখন, কত তারিখে ও কোন রাতে সংঘটিত হয়েছে তা জানা আবশ্যক নয়। কেননা যে রাতে মেরাজ সম্পন্ন হয়েছে তা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্যাদাশীল রাত কিন্তু এ মর্যাদায় প্রতিবছর রাতটি মহামান্বিত হবে সে রকম কোন তথ্য কুরআন হাদিসে নেই। তাই মেরাজের আলোচনা করা ও তার শিক্ষা গ্রহণ করার অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে; কিন্তু শবে মেরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বলতে ইসলামে কিছু নেই। অতএব এ রাতকে ঘিরে আমাদের সমাজে যে সকল রেওয়াজ আছে সবই কুসংস্কার বা বেদআত। কোন বছর মেরাজ হয়েছিল শুধু এ বিষয়টি নিয়েই হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রচিত সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারি কিতাবে প্রায় দশটি মতামত পাওয়া যায়। তেমনি কোন মাসে হয়েছিল তা নিয়েও ইতিহাসের বিভিন্ন কিতাবে পাঁচটি মত পাওয়া যায়। তবে নবুওয়তের দশম বা একাদ্বশতম বছরে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারটি অধিকতর সুস্পষ্ট। বস্তুত দাওয়াত ও রিসালাতের কাজে মুহাম্মদে আরবি প্রায় দশ,এগার বছর কাটিয়ে দিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি কাফেরদের তিরস্কার,বিদ্রুপ, নির্যাতনসহ ত্যাগ-কুরবানি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কঠিন এক সময় পার করেছিলেন। এ সকল ত্যাগের বিনিময় স্বরূপ আল্লাহ পাক এক মহান নেয়ামত দিয়ে হাবিবে আরাবিকে ধন্য করলেন এবং সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করলেন। যে কারণে শবে মেরাজ পালন করা থেকে বিরত থাকতে হবে- ক) মেরাজ সংঘটিত হওয়ার পর নবীজি প্রায় ১২/১৩ বছর জীবিত ছিলেন। এ সময়ে ১টিবারও রাতটি উদযাপন করেননি বা এ সম্পর্কে বিশেষ কোনো নির্দেশনাও দেননি। খ) নবীজির ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম পৃথিবীতে আরো একশ’ বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু কোন সাহাবি থেকে শবে মেরাজ পালন করা ও গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। গ) দীন সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত সাহাবায়ে কেরাম। কারণ তারা সরাসরি নবীজির কাছ থেকেই দীন শিখেছেন। তারা যা করেননি, বলে যাননি; আমরা তাতে আবেগ দেখানোর কিছু নেই। ঘ) যদি এ রাতের বিশেষ কোন তাৎপর্য থাকতো, তাহলে অবশ্যই রাতটি শবে কদর ও শবে বরাতের মতো নির্ধারিত হত বা নির্দেশনা সংরক্ষিত থাকতো। যেখানে মেরাজের বছর ও মাস নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে, সেখানে রাতটি নিশ্চিত করণের বিষয়টি হাস্যকরই বটে। প্রশ্ন হতে পারে, যারা শবে মেরাজ পালন করেন তারা অবশ্যই এ রাতে অপরাধ না করে এবাদত বন্দেগী করে কাটান। তাহলে আপত্তি কেন?? হ্যাঁ, ইসলাম অর্থ আনুগত্য। কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত সবকিছু দ্বিধাহীন মেনে নেওয়ার নাম ইসলাম। পক্ষান্তরে যা প্রমাণিত নয় তাকে দীন মনে করে পালন করার নামই বেদআত। সকল প্রকার দ্বিধা ও যুক্তির উর্ধ্বে গিয়ে সঠিকভাবে ইসলাম পালনই কাম্য। উল্লেখ্য, রজব মাস হল কুরআনে বর্ণিত সম্মানিত চার মাসের একটি। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে গণনায় মাস হল ১২টি, তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। কাজেই তাতে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করো না।’ (সুরা : তাওবাহ, আয়াত : ৩৬) এখানে চারটি মাসকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়েছে। বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে প্রদত্ত খুতবায় রাসুল সা. সম্মানিত মাসগুলোকে চিহ্নিত করে বলেন, ‘তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক—যিলকদ, যিলহজ ও মুহররম, অন্যটি হলো রজব।’ (বুখারি, হাদিস : ৩১৯৭, মুসলিম, হাদিস : ১৬৭৯) তাই কোন রাতকে নির্ধারণ না করে পুরো মাস ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা; বিশেষত গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যেমনটি আয়াতের শেষাংশে উল্লেখ করেছেন- ‘তোমরা তাতে নিজেদের প্রতি অবিচার করো না’। অংশটির ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রা. বলেন, সম্মানিত মাসে পাপ করা অন্য মাসের তুলনায় গুরুতর তেমনি নেকি করা অন্য মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। (তাফসিরে ইবনে কাসির) এছাড়াও রমযানের প্রস্তুতি নেওয়া ও রমযান পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করা এ মাসের করণীয়। আনাস বিন মালিক বলেন রা বলেন, যখন রজব মাস আসতো তখন নবীজি এই দোয়া পড়তেন, হে আল্লাহ রজব ও শাবান মাসে বরকত দাও। রমযান পর্যন্ত হায়াতে পৌঁছিয়ে দাও। মুসনাদে আহমাদ-১/২৫৯ লেখক- প্রধান শিক্ষিকা, মানারাতুল উলুম মহিলা মাদরাসা, উত্তর বালুচর, সিলেট।