বিভিন্ন হাদীসে, সাহাবা ও তাবেয়ীনগনের বিভিন্ন উক্তিতে সুন্নাহ শব্দটি অনেক বেশি পরিমানে এসেছে এবং সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার প্রতি অনেক বেশি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সুন্নাহ শব্দের সঠিক অর্থ না বুঝার কারণে বিভিন্ন ধরনের ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তাই সুন্নাহ শব্দের সঠিক অর্থ আমাদের সামনে স্পষ্ট হওয়া জরুরী। সুন্নাহ শব্দটির একদিকে বিভিন্ন আমলের ফিকহী স্তরবিন্যাসের একটি পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফুকাহাগন শরীয়ত সমর্থিত আমলসমুহকে চার স্তরে ভাগ করেছেন, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাহ, মুস্তাহাব, মুবাহ। এই স্তরবিন্যাসে সুন্নাহ বলতে আমলটি ফরজ বা ওয়াজিব নয় বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। মুহাদ্দিসগন সুন্নাহ শব্দটিকে হাদীসের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আবার সুন্নাহ শব্দটি বিদআতের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়। ফলে কোন আমল সুন্নাহ নয় শুনলেই কিছু মানুষ সেটিকে বিদআতের মতো পরিত্যাজ্য জ্ঞান করতে থাকে। হাদীস ও সাহাবা রাঃ এর ক্বওলসমুহে সুন্নাহ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, ওলামাগন তার অর্থ করেছেন দ্বীনের মধ্যে শরীয়ত সমর্থিত অনুসৃত পদ্ধতি বা কাজ, চাই সেটি ফরজ হোক বা ওয়াজিব, মুস্তাহাব হোক বা মুবাহ। যখন কোন আমলকে নিন্দনীয় সুন্নাহর খেলাফ বলা হয়, তখন সেটি দ্বারা সাধারণত দ্বীনবিরোধী কোন বিদআতমূলক কর্মকান্ডকে বুঝানো হয়। শরীয়ত অনুমতি দেয় এমন কোন কাজকে সুন্নাহর খেলাফ বলে নিন্দা করার সুযোগ নেই। শরীয়তের আমল বা ইবাদতগুলো লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই, কোন আমল কোন সময় বা পদ্ধতি বা শব্দের সাথে নির্দিষ্ট, আবার কোন আমল সময় বা পদ্ধতি বা শব্দের সাথে নির্দিষ্ট নয়। যে আমলসমুহ সময়, পদ্ধতি ও শব্দের সাথে নির্দিষ্ট, সে আমলকে অন্য কোন সময়ে, পদ্ধতিতে বা শব্দে আদায় করলে তা নিন্দনীয় ও বিদআত বলে গন্য হবে। আর যে আমলগুলোর জন্য সময়, কিংবা পদ্ধতি বা শব্দ নির্দিষ্ট নয়, শরীয়ত সেটিকে কোন সময়, পদ্ধতি বা শব্দের সাথে নির্দিষ্ট করে নি, তা শরীয়ত সমর্থিত যে কোন সময়ে, পদ্ধতিতে এবং শব্দে আদায় করা যাবে। তবে এই অনির্দিষ্ট আমলগুলোকে কেউ আবশ্যকীয়ভাবে কোন বিশেষ সময়, পদ্ধতি বা শব্দের সাথে নির্দিষ্ট করলে তাও নিন্দনীয় কাজ ও বিদআতে পরিণত হবে। এবার আমরা এমন কিছু আমলের কথা বলবো, যে আমলগুলো বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সময়, পদ্ধতি ও শব্দের সাথে খাস, আবার সময়, পদ্ধতি ও শব্দ অনির্দিষ্ট রেখেও সুযোগ সুবিধা মতো আদায় করার অবকাশ শরীয়ত রেখেছে । যেমন যিকর, দোয়া, দ্বীনের দাওয়াত দেয়া ইত্যাদি। যিকরের প্রসঙ্গে বলা যায়, বিশেষ কতগুলো ক্ষেত্রে যিকর নির্দিষ্ট, তার সময়, পদ্ধতি ও শব্দও নির্দিষ্ট। যেমন, সালাম, আযান, ইকামাত, হাঁচির জবাবে, কারও বিপদ বা মুৃত্যুুর কথা শুনলে ইত্যাদি। আবার অনির্দিষ্টভাবে সবসময় বেশি বেশি যিকর করার হুকুম করা হয়েছে। শরীয়ত সমর্থিত যে কোন সঠিক অর্থবিশিষ্ট শব্দ যার দ্বারা আল্লাহপাকের মহত্ত্ব, বড়ত্ব, প্রশংসা প্রকাশ পায়, তা পৃথিবীর যে কোন ভাষায় হোক, চাই তা কারও সাথে আলাপের সূরতে হোক বা নিজে নিজে হোক, উদ্দেশ্য যদি হয় আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি ও নেকি হাসিল, তবে এর দ্বারাও যিকরের ইবাদত আদায় হবে এবং নেকিও পাওয়া যাবে, তবে এই শর্তের সাথে এই ধরনের নির্দিষ্ট শব্দে ও পদ্ধতিতে করাকে আবশ্যক ও মাসনূন মনে করবে না। যিকরের কিছু শব্দ মাসনূনও রয়েছে, তাতেই নিঃসন্দেহে বেশি নেকি পাওয়া যাবে, কিন্তু অন্য গায়রে মাসনূন কোন শরীয়ত সমর্থিত শব্দে যদি কেউ যিকর করে তবে তাকে নিন্দনীয় মনে করা বা বিদআত মনে করাটা একটা নতুন বিদআত ও সুন্নাহবিরোধী হবে। দোয়া ও দাওয়াতের ক্ষেত্রেও এই কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। একই বিষয়টি দরুদ শরীফের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দরুদ শরীফ পাঠ করার কিছু ক্ষেত্র এমন আছে, যেখানে মাসনূন তথা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমানিত দরুদই পড়তে হবে। যেমন সালাতে বৈঠকের সময় বা সালাতুল জানাযাতে যে দরুদ পড়া হয়। আবার অনির্দিষ্টভাবে যে কোন সময় শরীয়তসম্মত যে কোন শব্দে, যে কোন ভাষায় রাসুলের উপর দরুদ ও সালাম পেশ,করলে তাও মাশরু' শরীয়ত সমর্থিত, সালাফগন নিজেরাও এ ধরনের দরুদ পড়েছেন, নিজেরা রচনা করেছেন। যেমন ইমাম শাফেঈ রহঃ রচিত দরুদ রব্বি সাল্লি ওয়া সাল্লিম দায়িমান আবাদা খুবই প্রসিদ্ধ। তো এই সব দরুদের দ্বারাও তারা নেকীর আশা করেছেন এবং কেউ এসব দরুদ নিয়ে নিন্দাও করে নি। কারন তা জায়েজ। তাহলে যে সব ইবাদতের কিছু প্রকার এমন আছে যেখানে শরীয়ত প্রশস্ততা রেখেছে শব্দ বা সময় বা পদ্ধতির, সে ইবাদতকে তেমনই প্রশস্ত মনে করাটাই সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত, নস দ্বারা প্রমানিত, সেটিও দ্বীনের অনুসৃত শরীয়ত সমর্থিত পদ্ধতি। একে অহেতুক সমালোচনার পাত্র বানানো বা নিন্দনীয় মনে করা ঠিক নয়, বরং শরীয়তের মুবাহকে মুবাহ মনে করাই সুন্নাহ। যতক্ষণ পর্যন্ত এতে কোন খারাবি যোগ না হচ্ছে, যতক্ষণ এতে কোন বিশেষ ধরণ বা শব্দকে আবশ্যক মনে করা না হচ্ছে, যখন এর সাথে অন্য সময়ে মাসনূন শব্দেও তা আদায় হচ্ছে ততক্ষণ অহেতুক তার পেছনে লাগা শরীয়তের মেজাজ নয়।