চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৬০ শতাংশ। কিন্তু এখনই এ মেগা প্রকল্প নিয়ে সংকটে পড়েছে বাস্তবায়নকারী চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। মূলত চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় একাধিক মেগা প্রকল্পের সংযোগ হওয়ায় সুষ্ঠু যানবাহন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে চট্টগ্রাম ট্রাফিক বিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে এসে এক্সপ্রেসওয়েকে ঘিরে নতুন প্রকল্প নিতে হচ্ছে সিডিএকে। নতুন করে নকশাও প্রণয়ন করতে হচ্ছে। এতে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নতুন প্রকল্পগুলোর সুফল পেতেও দেরি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বন্দরকেন্দ্রিক যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ২০১৭ সালে নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত পথে হাতে নেয়া হয় এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এসে এক্সপ্রেসওয়ের পিলার পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। ৩ হাজার ২৫১ কোটি টাকার এ প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি কাজ শেষ হলেও এ পথ নিয়ে সংকট কাটেনি। টেকসই সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্পটির কাজ শুরুর পর কয়েক দফায় নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া বাস্তবায়নের পর নানাবিধ সংকটের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) এক সভায় চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হলে সেখান দিয়ে গাড়ি চলাচলে ভবিষ্যৎ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়। সে অনুযায়ী প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে যানজট নিরসনের পরিবর্তে নতুন সংকট সৃষ্টি হতে পারে। সিএমপির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে জি-১ ও জি-২ রোডে ডানমুখী চলাচলের কোনো লেন না থাকায় এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যানবাহন চলাচলে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হবে। সেই সঙ্গে সৃষ্টি হবে তীব্র যানজট। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সমাধান না করে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে তার সুফল পাওয়া যাবে না। সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে সিএমপির কারিগরি টিমের পক্ষ থেকে এক্সপ্রেসওয়ে-সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে কিছু পরামর্শ দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে জি-১ ও জি-২ রোডের ভবিষ্যৎ যানজট সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) ও সিডিএকে তিনটি ইউলুপ নির্মাণের প্রস্তাব। এক্ষেত্রে ইউটার্ন-১ নির্মাণ করতে হবে সিডিএ জিআই এক্সপ্রেসওয়ের নিচ দিয়ে, ইউটার্ন-২ নির্মাণ করতে হবে জি-১ রোডে ও ইউলুপ-৩ নির্মাণ করতে হবে বিমানবন্দর রোডে। সিডিএ বলছে, সিএমপির পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে সংকট নিরসনে বেশ কয়েকটি নতুন নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। মূলত জি-১ ও জি-২-এর মধ্যে আউটার রিং রোড, বঙ্গবন্ধু টানেল, এয়ারপোর্ট রোডকে ঘিরে এসব নকশা করা হচ্ছে। দুটি ফেজে সম্ভাব্য এসব সংকট নিরসনের চেষ্টা করছে সিডিএ। প্রথম ফেজে এক্সপ্রেসওয়ের জন্য জংশনগুলো নির্মাণ করা হবে। এরপর দ্বিতীয় ফেজে নতুন সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস লেন নির্মাণ, র্যাম্প, পার্কিংসহ সড়ক প্রশস্তকরণের বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হবে। এর মধ্যে জি-১-এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু টানেলের সঙ্গে নগরীর সংযোগ বাধাহীন করতে জংশনগুলো নির্মাণ করা হবে। তাছাড়া নগরী ও ইপিজেড এলাকার যানবাহনগুলো টানেলের সামনে দিয়ে আউটার রিং রোডে বের হওয়ার জন্য জি-২-এর মাধ্যমে আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনা ও যানজটবিহীন সড়ক তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে। এসব নকশা প্রণয়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে সিডিএ। এ প্রসঙ্গে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বণিক বার্তাকে বলেন, সিএমপি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যানজট নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সে বিষয়টি আমরা অবগত আছি। আমাদের নকশা অনুযায়ী কাজ চলছে। যেহেতু ট্রাফিক সিস্টেম ব্যবস্থাপনা সিএমপি নিয়ন্ত্রণ করে, সেজন্য তারা আমাদের কিছু নকশা সংস্কারের কথা বলেছে। আমরা তাদের দেয়া পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের কারিগরি দল নতুনভাবে তিনটি সড়কের সমন্বয় করার জন্য নকশা প্রণয়ন কাজ করছে। শহরের তিন শিল্পাঞ্চল (ফৌজদারহাট, নাসিরাবাদ ও কালুরঘাট শিল্পাঞ্চল) ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে বন্দরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে নগরীর লালখান বাজার থেকে শাহ্ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে শহর থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে যাওয়া যাবে। চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্যের বিশেষায়িত উড়াল সড়কটির প্রস্থ ১৬ মিটার। এক্সপ্রেসওয়ের মোট নয়টি স্থানে গাড়ি চলাচলের জন্য ২৪টি র্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। ২৪টি র্যাম্পের মধ্যে টাইগারপাস এলাকায় চারটি, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে চারটি, বারিক বিল্ডিং মোড়ে দুটি, চট্টগ্রাম বন্দরসংলগ্ন নিমতলী মোড়ে দুটি, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ মোড়ে দুটি, চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষ (সিইপিজেড) এলাকায় চারটি, কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় (কেইপিজেড) দুটি, কাঠগড় এলাকায় দুটি পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় দুটি র্যাম্প থাকবে। প্রতিটি র্যাম্প নির্মাণ হবে দুই লেনের। র্যাম্পগুলো একমুখী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হবে। নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নানা সংকট ও সমালোচনার মুখে পড়েছে। বন্দর এলাকার পাশ দিয়ে উড়াল সড়ক যাওয়ার বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের আপত্তি ছিল। আবার এ পথ নির্মাণের জন্য লালখান বাজার এলাকায় পাহাড় কাটার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে পরিবেশবাদীরা এর প্রতিবাদ করেন। এছাড়া দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের বিষয়েও সংকটের মধ্যে পড়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর আগেই সিটি করপোরেশনের একাধিক ভবন নির্মাণ হয়ে যাওয়ায় এ এলাকা দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করাও প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিএমপির উপকমিশনার (ভূসম্পত্তি ও উন্নয়ন) এসএম মোস্তাইন হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য সড়ক অবকাঠামো যুগোপযোগী করতে আমরা নগরীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ টানেলের সংযোগের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে জরিপ করেছি। কোথায় যানজট হবে বা ভবিষ্যতে কী সমস্যা হবে সে বিষয়গুলো জানিয়েছি। এখন সিডিএ তাদের কমিটির মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে সিএমপির পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বণিক বার্তাকে জানান, চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ৬০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। নতুন কিছু কাজের নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। এখন বারিক বিল্ডিং থেকে কাস্টামস মোড় পর্যন্ত কাজ হচ্ছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার কিছু পাওনা ছিল, সেগুলো পরিশোধ করা হয়েছে। বন্দরের সঙ্গে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান হয়েছে। প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে কাজ চলছে। চট্টগ্রাম শহরের জন্য বিশেষায়িত এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাঝপথে এসে এক্সপ্রেসওয়ের জন্য নকশা পরিবর্তন, নতুন কম্পোনেন্ট যুক্ত করার বিষয়টি অপরিকল্পিত উদ্যোগের ফল বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, টানেল নির্মাণ কিংবা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প শুরুর আগেই এসব বিষয়ে সিডিএর উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। সিডিএর এ ভুলের কারণে প্রকল্পের সুফল পেতে দেরি হওয়ার পাশাপাশি অর্থের অপচয় হবে। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের সঙ্গে আউটার রিং রোড ও নগরীর সঙ্গে সংযোগের বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনায় বড় ধরনের গলদ আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা অংশের সঙ্গে গাড়ি চলাচল নিয়ে সামনে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। কিন্তু সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এ করেণে সিএমপির পর্যবেক্ষণের পরে এখন নতুন করে নকশা প্রণয়ন করছে। এভাবে সমস্যার সমাধান হবে না। টানেলে গাড়ি চলাচল আরো সহজ করতে হলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ইউলুপ নির্মাণ জরুরি। ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এ প্রকল্প ব্যয়ে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। প্রায় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ প্রকল্পের কাজের মেয়াদ ধরা হয় তিন বছর। সিডিএর প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যাঙ্কিন।